breaking

Friday 10 December 2021

বাংলার লোকায়ত উৎসব “মূলো ষষ্ঠী”

বাংলার লোকায়ত উৎসবের অন্যতম প্রধান উৎস হল ষষ্ঠী পূজা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী প্রত্যেক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতিথিতে একটি করে ষষ্ঠী পূজা হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষষ্ঠী, শ্রাবণ মাসে লোটন ষষ্ঠী, ভাদ্র মাসে মন্থন ষষ্ঠী, আশ্বিন মাসে দুর্গা ষষ্ঠী, অগ্রহায়ণ মাসে মুলা ষষ্ঠী, পৌষ মাসে পাটাই ষষ্ঠী, মাঘ মাসে শীতল ষষ্ঠী, চৈত্র মাসে নীল ষষ্ঠী। ষষ্ঠী পূজা সাধারণত নারীরা তাদের সন্তানের মঙ্গল কামনার জন্য করে থাকে। বাংলা বাদেও উত্তর প্রদেশ ও বিহারে ষষ্ঠী পূজা হতে দেখা যায়। বাংলার বিশেষত পূর্ববাংলার নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে এই ষষ্ঠী পূজার চল সর্বাধিক। সাধারণত ব্রাহ্মণদের দিয়ে পুজো করা হলেও ব্রত কথাগুলি এই পূজার মূল মন্ত্র।
  অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে মুলা ষষ্ঠীর ব্রত পালিত হয়ে থাকে। প্রসাদ হিসেবে প্রধান উপাদান হলো মুলা ও তার সাথে আর চার রকমের সবজি। এই চার রকমের সবজি গুলির মধ্যে মেটে আলু, শিম, বরবটি, বেগুন উল্লেখযোগ্য। পূজা শেষে এই দিন ওই পাঁচ রকমের সবজি দিয়ে নির্মিত তরকারি প্রসাদ রূপে খেতে হয়।
এই ব্রতের, পেছনে প্রচলিত কাহিনীটি অনেকটা এমন --- এক গ্রামের এক বামন বাড়িতে এক ছেলে তার বউ ও বাবাকে নিয়ে থাকতেন। শ্বশুরমশাই বৌমার কাছে একদিন হরিণের মাংস খাওয়ার আবদার করে। যথারীতি বৌমা হরিণের মাংস যত্ন সহকারে রেধে দেন। শশুর মশাই তখন বাড়ি ছিলেন না। বাড়ির কাজের মেয়ে সেই মাংস নিয়ে আসার সময় তা ফেলে দেয় এবং যথারীতি মাংস নষ্ট হয়ে যায়। শাস্তি পাবার ভয়ে সেই কাজের মহিলা বাইরে বাছুরের পেট থেকে মাংস কেটে এনে তা রান্না করে রাখে। বাছুরটি যথারীতি মারা যায় কিন্তু বৌমা বুঝে ফেলে কাজের মহিলা কিছু একটা গন্ডগোল করেছে। কাজের মহিলাকে জেরা করায় সে সব স্বীকার করে। শশুরকে এই মাংস দেওয়া যাবে না আবার মাংস না দিলেও তিনি রাগারাগি করবেন, কি করবে বুঝতে না পেরে বৌমা একটা বুদ্ধি আটে। তিনি কাজের মহিলাকে বলেন, মেঝের উপর ফেলে রাখতে শ্বশুরমশাই যখন বাড়ি ফিরবেন তখন বৌমা সেই তেলের উপর পা দিয়ে উল্টে পড়ে যাবেন ও অজ্ঞান হবার ভান করবে। তখন বৌমাকে নিয়ে শোরগোল পড়ে গেলে শ্বশুরমশাই মাংসের ব্যাপারটা ভুলে যাবেন। কিন্তু বাছুর যে মারা গেছে তা কি করে প্রকাশ করবে তিনি বুঝতে পারেন না। এই বলে বউ মা স্নান সেরে যথারীতি মা ষষ্ঠীর পূজা করতে বসেন। তখন ষষ্ঠী দেবী স্বপ্নাদেশ দেন তার পূজার ঘটের জল নিয়ে বাছুরের পেটে ছিটিয়ে দিতে বলে। বৌমা সেই ঘটের জল নিয়ে বাছুরের পেটে ছিটিয়ে দিলে বাছুর টি বেঁচে ওঠে। এই অবিশ্বাস্য ঘটনার পর বৌমা ঘটা করে অগ্রহায়ণ মাসের শুক্ল পক্ষ মুলা ষষ্ঠীর ব্রত শুরু করেন। এইজন্য এই পূজার দিন কোনো রকম মাছ মাংস খেলে তা গোমাংস ভক্ষণের সমান হয়, তাই এই দিন নিরামিষ আহার চলে। গল্পটি জায়গায় ভেদে পরিবর্তিত হলেও, মূল কাহিনীটি মোটামুটি এক।
এই পূজা করার আগে নারীদের মন্ত্র নিতে হয়, এই মন্ত্র নেওয়ার পদ্ধতিটি খুবই মজাদার। নারীদের প্রথমে পাটকাঠি দিয়ে তিনটে ঘর বানাতে হয়, তিনটি ঘরে যথাক্রমে পাটকাঠি, সুতা ও ঝাটা রাখা হয়। মেয়েটি প্রথম ঘরে গিয়ে পাটকাঠি ধরলে বাইরে থেকে অন্য কোন মহিলা জিজ্ঞাসা করে, “ও মেয়ে তুমি কি করো?” মেয়েটির উত্তর আসে, “ভগবান যা করায় তাই করি।” এরপর দ্বিতীয় ঘরে গিয়ে মেয়েটি সুতো কাটতে থাকে। আবার বাইরে থেকে প্রশ্ন আসে, “ও মেয়ে তুমি কি করো?” মেয়েটি উত্তর দেয়, “এই ভগবানের সুতা কাটি।” এমনভাবে তৃতীয় ঘরে গিয়ে ঝাঁটা নিয়ে ঝাঁট দিতে থাকলে একই প্রশ্ন আসে আর তখন মেয়েটি উত্তর দেয়, “ভগবানের ঘর ঝাঁট দিই।”
এই পর্ব শেষ হওয়ার পর, সেই মেয়েকে পুকুরে যেতে হয় এবং সেখান থেকে যে কোন মাছ ধরে স্নান করে বাড়ি ফিরতে হয়। তারপর সেই মাছ ষষ্ঠী দেবী কে উৎসর্গ করে পূজা করে তার মন্ত্র নেওয়া সমাপ্ত হয়।
বাংলার এইসব লোকায়ত উৎসব গুলি আজ প্রায় হারানোর মুখে। তাই মা ঠাকুমার করা সেই পূজার্চনা গুলি যেমন ভাবে করতে দেখেছি তার কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।