breaking

Thursday 4 November 2021

বাংলার বালুচরির ইতিহাস

 



বাঙালি নারী আর শাড়ি, এই দুয়ের মেলবন্ধন পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের যেকোন মানুষকে বাঙালির প্রেমে পড়তে বাধ্য করে তুলতে পারে। সময়ের সাথে সাথে বাঙ্গালীদের বেশভূষায় কিছু পরিবর্তন আসলেও এখনো ঐতিহ্যবাহী বাঙালি শাড়ি পড়তে ভালবাসে না এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলা চিরকালই তার সুতি ও মসলিনের জন্য জগৎবিখ্যাত। আর এই শাড়ির মধ্যে অন্যতমের শিরোপা ধারণ করে আছে বাংলার বালুচুরি শাড়ি। বালুচুরির সাথে ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত।



ঘটনার সূত্রপাত সপ্তদশ শতক থেকে, ইউরোপীয় বণিক শ্রেণি বিশেষত ডাচ, পর্তুগিজ ও ইংরেজদের মধ্যে ঘটে চলেছে বাংলার মসলিন কে কেন্দ্র করে এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই সময় বাংলা ও চীন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মসলিন রপ্তানিকারক দেশ। উন্নত মানের সিল্কের সাথে যখন বাংলার সুদক্ষ শ্রমিকদের হাতের ম্যাজিকের মেলবন্ধন ঘটে তখন জন্ম নেয় বালুচুরি শাড়ির। ইউরোপীয় বণিকরা এই শাড়ি লাভের আশায় একের পর এক কারখানা গড়ে তুলতে থাকে মুর্শিদাবাদ ও মালদা কে কেন্দ্র করে।



১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ তার রাজধানী ঢাকা থেকে মুকসুদাবাদে (বর্তমান মুর্শিদাবাদ) স্থানান্তরিত করেন। নবাবের সাথে সাথে ঢাকার সমস্ত দক্ষ শ্রমিক, তাঁতি, শিল্পীরাও এসে ভিড় করতে থাকে নবনির্মিত রাজধানী শহরে। নবাব তাদের আশ্রয় দেন গঙ্গার পাড়ে বালুচর (বর্তমান জিয়াগঞ্জ) নামক গ্রামে। এই বালুচরে বসবাসরত শিল্পীদের হাতেই গড়ে ওঠে জগৎবিখ্যাত শাড়ি বালুচুরি।

বালুচুরি শাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর পার ও মূল অংশে বিভিন্ন গল্পকথা অবলম্বনে ছবি ফুটিয়ে তোলা। এই ছবি সুতোর নিপুন বুনোট দিয়ে তৈরি করতে প্রয়োজন হতো বিপুল দক্ষতার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছবিগুলো থাকতো নারী-পুরুষের অবয়ব, দেবতাদের চিত্র, কোন প্রাচীন উপকথা। 

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পর রাজনৈতিকভাবে এক বিপুল পটপরিবর্তন ঘটতে থাকে। ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয় ইংরেজদের হাতে। এই ক্ষমতার পরিবর্তনের প্রভাব বালুচুরি শাড়িতেও দেখতে পাওয়া যায়। শাড়িতে নতুন নতুন চিত্র ফুটে উঠতে থাকে যেখানে গভর্নর জেনারেলদের ছবি, মদের পেয়ালা, ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র, পাশ্চাত্য উপকথা সমস্ত ছবি ফুটে উঠতে থাকে।

বালুচুরি শিল্পীদের বিস্তার ক্রমশই বালুচর গ্রাম থেকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই সমস্ত অঞ্চল গুলি কে একত্রে বালুচর সার্কেল হিসেবে বলা হতে থাকে। এই সার্কেল এর অন্যতম প্রধান শিল্পী ছিলেন দুবরাজ নামে এক তাঁত শিল্পী। যার বাড়ি ছিল বাহাদুরপুর গ্রামে। এই  দুবরাজের হাত ধরেই মূলত সারিতে হিন্দু উপকথা, রামায়ণ ও মহাভারতের মত কাহিনীগুলো শাড়ির গায়ে বোনা হতে থাকে।



মুর্শিদাবাদ ও দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে একের পর এক খরা, দুর্যোগ, ভূমিকম্প, মন্বন্তর দেখা দিতে লাগলে শিল্পীরা পশ্চিমে মল্লভূম (অধুনা বিষ্ণুপুর) অঞ্চলে গিয়ে বসতি গড়ে তোলে। মল্লভূমি বা বিষ্ণুপুর ছিল টেরাকোটার কাজের জন্য বিখ্যাত, এই টেরাকোটার ছোঁয়া বালুচুরি শাড়িতেও পড়তে দেখা যায়। মূলত এই শাড়ি গুলি লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, আকাশি, নীল রঙের হয়ে থাকত কিন্তু কালো রঙের কোনো শাড়ি হত না। তার অন্যতম কারণ কালো রং হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী অশুভের প্রতীক হিসেবে ধরা হতো।

বর্তমানে সেই শাড়ির গরিমা হারিয়ে গেলও পুনরায় তা ফিরিয়ে আনার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালানো হচ্ছে।



কলমে ঃ- ACHINTA MONDAL