breaking

Monday, 15 November 2021

রঘু ডাকাতের কাহিনী

     ইংরেজ শাসনের দীর্ঘ প্রায় ২০০বছরের পরাধীনতার ইতিহাসে ইংরেজরা শুধুমাত্র যে ভারতীয়দের শারীরিক ও অর্থনৈতিক ভাবেই শোষণ করেছে তা নয় বরং সুচতুর ভাবে ভারতীয় ইতিহাসকে মিথ্যের মোড়কে মুড়ে তাকে করেছে ধ্বংস। স্বাধীনতাপ্রেমী বীরেরা যখনই তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে, হয় তাদের পেতে হয়েছে কঠোর শাস্তি বা তাদেরকে পেতে হয়েছে সন্ত্রাসবাদী, ডাকাত বা লুটেরার মত বদনাম। সেই মিথ্যে ইতিহাসে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীর মত বিপ্লবীরা হয়েছেন সন্ত্রাসবাদী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা রঘুনাথ আচার্য্য হয়ে গেছে কুখ্যাত রঘু ডাকাত।
ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের পর, (যা ছিল মূলত বস্ত্র শিল্প কেন্দ্রীক) শিল্পের তাগিদে কাচামাল, বিশেষত নীলের চাহিদা দেখা দিতে থাকে। বিদেশে নীলের রপ্তানি করা ও তা থেকে মোটা অঙ্কের মুনাফা কামানোর লোভে বহু ইংরেজ ব্যবসায়ী ব্যাবসা ছেড়ে বাংলার গ্রাম গঞ্জে গিয়ে নীল কুঠি খুলে বসতে থাকে। সামান্য কিছু দাদনের পরিবর্তে গরীব চাষীদের নীল চাষ করাতে বাধ্য করতে থাকেন। প্রথমে “পাঁচকাঠিয়া” থাকলেও ক্রমেই তা “দশকাঠিয়া” হয়ে যায়। শুরু হয় জোড় করে জমি দখল করে নীল চাষ করানো।

এমনই এক নীলকর সাহেব ম্যালকম সপ্তগ্রাম অঞ্চলে তাঁর ঘাঁটি গড়ে তোলেন। তাঁর ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত গাজেন ঘোষ নামের এক স্থানীয় ব্যক্তি। এই মালিক ও ম্যানেজার মিলে গ্রামে নীলের আবাদ বাড়াতে থাকেন। যার যে জমি পছন্দ হত, তারা রীতিমত জোড় পূর্বকই তাদের নীল চাষ করাতে বাধ্য করতেন। 
ওই গ্রামেই বসবাস করতেন রামপদ আচার্য্য নামের এক গরীব ব্রাহ্মণ। যজমান বাড়ির টাকাই ও পুকুর পাড়ের সামান্য জমি থেকে প্রাপ্ত ধান থেকেই তাঁর ছেলে ও এক বিধবা বোনের সংসার চলে যেত। রামপদের ছেলে রঘুনাথ ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ, লাঠি চালানোয় তার মতো লেঠেলের জুড়ি মেলা ছিল ভার। একদা গজেনের নজর পড়ে রামপদের ওই জমিতে, গজেন তাকে সেই জমিতে নীল চাষ করতে বলেন কিন্তু রামপদ তাতে রাজি হন না। গজেন কিছুদিন রামপদের টোলে পড়াশোনা করায় খুব একটা জোড় করতে পারেন না শিক্ষককে। কিন্তু ব্যাপারটা ম্যালকম সাহেবের কানে গেলে তিনি রামপদকে তাঁর কাছাড়ি বাড়িতে তুলে আনেন। সেখানে তাঁকে মারধর করা হয়, বেকায়দা ভাবে একটা লাঠির আঘাত মাথায় লাগলে রামপদ অচৈতন্য হয়ে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি রামপদকে রাস্তার ধারে ফেলে আসা হয়। পরে তাকে চিকিৎসা করেও আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
             (রঘু ডাকাতের আরাধ্যা কালি)
      পিতার মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে রঘুনাথ। তিনি গজেন ঘোষকে হুমকি দেন এর বদলা সে নেবেই। গজেন রীতিমত ঘাবড়েই গেছিল, এই কথা সে কাছাড়ী বাড়িতে ম্যালকম সাহেব ও দারোগার সামনে তুলে ধরেন। প্রথমে তারা রঘুর ব্যাপারে পাত্তা দিতেই নারাজ হন। গজেন কিন্তু কথাটা ভুলতে পারেনি, সে রঘুর চোখে আগুন দেখেছে। গজেন তার বাড়ির পাহারা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয় না। একদিন রাতে আগুনের তীব্র আলোয় সব পাহারাদারদের ঘুম ভাঙলে দেখে গজেনের বাড়িতে আগুন জ্বলছে। দেখা যায় রঘু তার সাথীদের নিয়ে আগুন দিয়েছে, পাহারাদাররা রঘুকে মারতে গেলে রঘুর লাঠির আঘাতে তারা কুপকাত হয়। গজেনের ঘর পুড়ে ছাই হয়। গ্রামের মানুষেরও মনে শান্তি আসে।
গজেন গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নেয় নদীর ওপারে শ্বশুর বাড়ি। হাকিম সাহেব ও দারোগার কানে কথাটা উঠলে রঘুর নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার বেশকিছুদিন পার হয়ে গেলেও গজেনের মন থেকে ভয় যায় না। সে আবার ঘর তুলতে শুরু করলেও দিনের বেলায় সপ্তগ্রামে থাকতেন আর সন্ধ্যের আগে শ্বশুর বাড়ি পালতেন। একদিন ঝড় বদলায় আটকে পড়ায় গজেন ফিরতে পারলো না, ভয়ে ভয়ে সন্ধ্যা কাটিয়ে দেবার পর রাতে ফেরার পথে হঠাৎই একদল লোক বল্লম হাতে তাকে ও তাঁর লেঠেলকে ঘিরে ধরে বেধে ফেলে। রঘু তখন গজেনের কাছ থেকে তার লুকানো সম্পদ চাইতে থাকে। প্রাণের ভয়ে গজেন তার বাড়িতে পুঁতে রাখা তিন ঘড়া মুদ্রা রঘুর হাতে তুলে দেয়।
                 (রঘুর কালি মন্দির)
        পরদিন গজেন রঘুর নামে ম্যালকম সাহেবের কাছে নালিশ জানালেও সেই তিন ঘড়া মুদ্রার কথা বলতে পারে না, সাহেব বুঝে যেতেন তার ম্যানেজার চুরি করেন। এর পরের কোপ পড়লো ম্যালকম সাহেবের ঘাড়ে। তার হীরে কেনার সখ ছিল, কারণ নগদ টাকার থেকে হীরে বিদেশে নিয়ে যাওয়া সুবিধা আর এখান থেকে কম দামে কিনে ওখানে বেশি দামে বিক্রি হয়। একদিন রাতে এক দিল্লীর হীরে ব্যাবসায়ী সেজে রঘু ম্যালকম এর কাছারি বাড়িতে যান, সুযোগ বুঝে তার মাথায়  পিস্তল ঠেকিয়ে প্রায় 20 টা হীরে লুঠ করে পালায়।
রঘুর নামে হুলিয়া জারি হয়, ও ধরিয়ে দেবার জন্য 1000 টাকার পুরুষ্কার ঘোষণা করা হয়। রঘুকে ধরিয়ে দেয় এক বাউল। সে খবর দেয়, রঘু তার বাবার কাজের জন্য বাড়ি আসছে আর সেদিন সে সব গরীবদের জিনিস প্রদান করবে। এই সুযোগে পুলিশ হানা দেয় রঘুর বাড়ি। রঘু নির্দ্বিধায় ধরা দেয়। ম্যালকম সাহেব রঘুকে তার অর্থ ফিরিয়ে দিতে বলে এবং তার পরিবর্তে তার শাস্তি কিছুটা কম করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু রঘু তাতে রাজি না হওয়ায়, তার নামে মিথ্যে মামলা সাজানো শুরু হতে থাকে। রঘু বুঝতে পারে তাকে হয় কালাপানি বা ফাঁসি যেকোন একটা দেওয়া হবে। তাই সে পালানোর পরিকল্পনা করতে থাকে। একদিন রাতে সে তার জেলের পাহারাদার পুলিশকে প্রচুর অর্থ দেবার লোভ দেখিয়ে তার সাহায্যে পালিয়ে যায়।
জেল থেকে পালানোর পর রঘুর নাম আরো বেশি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। রঘু দল গড়ে তুলে নীল চাষ বন্ধ করতে থাকে। জায়গায় জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই ঘটনা গুলি হরিশচন্দ্র এর “হিন্দু পেট্রিয়ট”এ ছাপানো হলে, সরকার  নীলকরদের অত্যাচার সম্বন্ধে অবগত হন। ইংরেজ দারোগার পরিবর্তে বাঙালি দারোগা  পরিবর্তন করা হয়, সঠিক দাদন দেবার ব্যাবস্থা করা হয়। কৃত্রিম নীল আবিষ্কারের পর এই নীলকরদের দমন বন্ধ হয়।