আমাদের অনেকেরই জানা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভানুসিংহ ছদ্মনাম গ্রহণ করেন এবং এই নামে তিনি রচনা করেন "ভানুসিংহের পদাবলী "। রবি ঠাকুরের ভানুসিংহ হয়ে ওঠার পেছনে এক সুন্দর কাহিনী আছে।
ছোটবেলা থেকেই বালক রবীন্দ্রনাথের পদাবলীর উপর ছিল তীব্র আকর্ষণ। বিশেষত মৈথিলী ভাষার শব্দ ঝংকার তাঁকে বেশি মুগ্ধ করত। অর্থ না বুঝেও তিনি পড়ে যেতেন পদাবলী, প্রচন্ড অধ্যবসায়ের সঙ্গে উদ্ধার করার চেষ্টা করতেন সেইসব না বুঝতে পারা শব্দের অর্থ। যাতে তিনি এই প্রাচীন রসভান্ডারের রসাস্বাদন করতে পারেন, সেখান থেকে তুলে আনতে পারেন দুষ্প্রাপ্য মণিমুক্তো।
প্রাচীন পদকর্তাদের প্রতি আকর্ষণের পাশাপাশি বালক ইংরেজ কবি চ্যাটার্টনের জীবনীও তাঁর উপর গভীর প্রভাব ফেলে। চ্যাটার্টন যিনি মাত্র ষোল বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন, তিনি প্রাচীন কবিদের কবিতার ধরন হুবহু নকল করতে পারতেন।
রবীন্দ্রনাথকে চ্যাটার্টনের এই কাহিনী অনুপ্রেরণা জোগায় ও তিনি চন্ডীদাস, বিদ্যাপতির অনুকরণে পদাবলী রচনা করতে থাকেন। গোল বাধে সেই পদাবলীর প্রকাশনা নিয়ে। এই পদাবলী তিনি রচনা করেছেন, একথা বললে পাছে তিনি গুরুজনের সমাদর না পান, তাই তিনি চাতুরির আশ্রয় নিলেন।
এক জৈনক প্রকাশক বন্ধুকে তিনি জানান, ব্রাহ্মসমাজের লাইব্রেরীতে তিনি একটি প্রাচীন পুঁথি খুঁজে পেয়েছেন, কোন এক 'ভানুসিংহ' এর রচনা করেছেন। তিনি সেই বন্ধুকে পুঁথি থেকে কিছু পদাবলী পড়ে শোনান। পদাবলী শোনার পর বন্ধু বলেন, এই ব্যক্তি বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাস এর চেয়েও বড় কবি। চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতির পক্ষেও এমন পদ সৃষ্টি সম্ভব ছিল না। সেই পদাবলী গুলি ছাপানোর জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথকে পুঁথিগুলি এনে দিতে বলেন। অগত্যা রবীন্দ্রনাথকে সমস্ত সত্যতা জানাতে হয়। কিন্তু কেবল মুখের কথায় তিনি মানতে চাইছিলেন না যে ভানুসিংহ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বাধ্য হয়ে নিজের লেখা খাতাটি দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রমাণ করাতে হয় ভানুসিংহ চরিত্রটি তাঁরই সৃষ্টি।
পরবর্তীকালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ প্রকাশিত হলে, পাঠকেরা ভানুসিংহকে প্রাচীন পদকর্তা হিসেবেই চিনেছিল। ড: নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়, যিনি ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে ভারতীয় গীতিকাব্যের তুলনা করে বই লিখেছিলেন ও ডক্টরেট ডিগ্রী পেয়েছিলেন, তিনি তাঁর বইতে ‘ভানুসিংহ’-কে প্রাচীন পদকর্তা রূপে বর্ণনা করে তাঁর কাব্যের ভূয়শী প্রশংসা করেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় ‘ভানুসিংহ’-কে যে সম্মানের আসন দিয়েছিলেন তা কোন আধুনিক কবির ভাগ্যে জোটে না।