ভারতের প্রথম ক্রিকেটের পথ চলা ১৯৩২ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তার আগেও বহু ভারতীয় ভারতের ক্রিকেটের ভিত শক্ত ভাবে গড়ে তুলেছিলেন। ৩৩ টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ১৭৯ টির ওপরে উইকেট পাওয়া, এই বাঁহাতি স্পিনার পালওয়ানকার বালো হয়তো ভারতের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু তার সম্বন্ধে না আছে তেমন কোনো লিখিত দলিল বা না হয় তেমন আলোচনা। ১৯৫৯ সালে “Kahintari Naveeh Kara”(Do something distinctive) নামে একটি মারাঠি পুস্তক বের হয় যেখানে বালোর জীবনের ওপর ত্রিশ পাতার একটি প্রবন্ধ ছাড়া আর তেমন কোনো দলিল তার সম্বন্ধে পাওয়া যায় না। মারাঠি এই গ্রন্থটিতে বালোর পাশাপাশি মারাঠি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সম্বন্ধে লেখা হয়েছিল। মারাঠি বাদেও কিছু ব্যক্তির নাম সেখানে উল্লেখ ছিল যাদের মধ্যে দুজন বাঙালি রামমোহন এবং রবীন্দ্রনাথও ছিলেন।
পালওয়ানকার (গোয়ার একটি গ্রাম পালওয়ান থেকে নামটি আসে) বালো, ১৮৭৫ সালে ধারওয়ার এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা পুনেতে আর্মিতে কর্মরত ছিলেন, মতান্তরে ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। জাতিগত দিক থেকে তাঁরা ছিল “চামার”(সংস্কৃত শব্দ চর্মন বা চামড়া)। বালো ও বালোর ভাই আর্মিদের ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়েই প্রথম ক্রিকেট খেলতে থাকে। বালোকে অল্প বয়সে কাজ শুরু করতে হয়, তিনি পার্সিদের একটি ক্রিকেট ক্লাবে পিচ দেখাশোনা ও ব্যাটসম্যানদের নেটে মাঝে মাঝে বল করার কাজ পান। তাঁর মাইনে ছিল মাসে ৩ টাকা। ১৮৯২ সালে তিনি পুনা ক্লাবে কাজ শুরু করেন, সেখানে তাকে পিচের পাশাপাশি মাঠের দেখভাল ও কখনো কখনো টেনিসের কোর্টেও কাজ করতে হতো, মাইনে ছিল ৪ টাকা।
সেই ক্লাবে ফাঁকা নেটে তাকে বল করতে দেখেন Mr. Tross নামের একজন খেলোয়াড়, তাঁর বলের প্রতি আকর্ষিত হয়ে ট্রস সাহেব তাকে বল করতে বলেন। ক্রমেই তাঁর বলের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়তে থাকলে আরো খেলোয়ার তাঁর বল খেলতে আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকে। ক্যাপ্টেন J.G.Grieg,( Jungly নামে পরিচিত) যিনি সেই সময়কার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন, তিনিও বালোকে তাঁর নেট বলার হিসেবে কাজে লাগাতে থাকেন। এতে যেমন ক্যাপ্টেনের ব্যাটিং শুধরে ছিল তেমনি বালোর বোলিংও হয়েছিল তুখর। শোনা যায় প্রতিবার আউটে ক্যাপ্টেন তাঁকে ৮ আনা করে দিতেন।
তৎকালীন সময়ে পুনা হিন্দু ক্লাব, নেটিভ ক্লাব হিসেবে ইউরোপিয়ান ক্লাব গুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছিল। তারা তাদের দলে বালোর মত একজন দক্ষ খেলোয়ার কে নেওয়ার জন্য খুবই উৎসাহী ছিল, কিন্তু দলের অন্যান্য ব্রাহ্মণ খেলোয়াড়দের অমত এর কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না। অনেকটা ক্যাপ্টেন ক্রেইগ এর প্রচেষ্টাতেই বালো পুনা হিন্দু ক্লাবে খেলার সুযোগ পায়। খেলার মাঠে একই বল দিয়ে খেললেও, মাঠের বাইরে চিত্রটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। প্যাভিলিয়নে ঠাঁই হতো না বাংলোর, আলাদাভাবে তাকে বসতে হতো আলাদা মাটির পাত্রে তাকে চা খেতে হতো এমনকি তাকে খাবার দেবার জন্য একটি অন্য অছ্যুত কাজের লোকের ব্যবস্থাও ছিল। নিজের টিমের মধ্যে এত ছোঁয়া ছুতের মধ্যেও বালোর মনোবল কিন্তু ভেঙে যায়নি, পুনা হিন্দু ক্লাবের হয়ে খেলে প্রথম ম্যাচেই পুনা ইউরোপিয়ান ক্লাবকে নিজের হাতেই হারিয়ে দেয় বালো। বালোর নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জিমখানা ক্লাবে খেলতে গেলে সেখানে যাতে বল স্পিন না করে সেই রকম পিচ বানানো হয়, তা সত্ত্বেও বালো সেই ম্যাচে ৭ উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে দেয়। বলে স্পিন ও ফ্লাইট এর উপর তার ছিল অসম্ভব দক্ষতা।
কথায় বলে ট্যালেন্ট সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে প্রকাশ পায়, তেমনই হয়েছিল বালোর সাথে। একদা যাকে “নীচু চামার জাতি” বলে অপমান করে দূরে সরিয়ে রাখা হতো, তাঁরই প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে প্রকাশ্য জনসভায় তাঁকে অভ্যর্থনা দেন মহাদেব গোবিন্দ রানাডে ও বালগঙ্গাধর তিলক এর মত জাতীয়তাবাদী নেতারা।
পরবর্তীতে ভালো বোম্বে বেরার সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে চাকরি পান ও তাদের হয়ে ক্রিকেট খেলতে থাকে।
বোম্বের মত আমাদের বাংলাতেও ক্রিকেটের আবেগ চিরকালীন। বাংলায় ক্রিকেটের প্রাণপুরুষ ছিলেন নাটোর ও কুচবিহারের রাজারা। নাটোরের রাজা সারা ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটারদের নিয়ে একটি ক্রিকেটের দল তৈরি করেছিলেন, যাকে প্রতিরোধ করা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। সেই দলে বালো ও বালোর দুই ভাই গণপতি আর ভিঠালও ছিলেন।
তথ্যসূত্র:-
1."A corner of a foreign field : the Indian history of a British sport" -- Ramchandra Guha