এর নাইকো রোষ সদাই তোষ মুখে বলে সত্য বল”
ব্রাহ্মণ্যবাদের আস্ফালন ও কঠোর রীতিনীতির বেড়াজালে যখন সাধারন মানুষ বীতশ্রদ্ধ ও ধর্মবিমুখ হয়ে যাচ্ছে তখন পতিত-পাবন রূপে আবির্ভূত হলেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু। তিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ছড়িয়ে দিলেন সহজ প্রেমের বাণী। মহাপ্রভুর মৃত্যুর পর, বাঙালির আধ্যাত্মিক ধর্ম সাধনায় সাময়িক ভাটা পড়লেও এই পূণ্যভূমি কখনো আধ্যাত্মিক গুরু শূন্য থাকেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝের দিকে যখন কালের হওয়ার পাল্টানোর সূচনা হচ্ছে তখন একজন সহজ সাধকের আবির্ভাব ঘটল, যিনি ধর্মাচরণের পথ সাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। গড়ে উঠলো নতুন সম্প্রদায় “কর্তাভজা”, আর তিনি আদি গুরু আউলেচাঁদ।
কর্তাভজা সম্বন্ধে জানার আগে আউলে চাঁদ সম্বন্ধে বলা দরকার। আউলে চাঁদ এমন নামকরণের পেছনের আসল কারণ জানা যায় না তবে, ছোটবেলা থেকে খ্যাপাটে ধরনের হওয়ায় এমন নাম হতে পারে। আবার মুসলিম সুফি গুরুর শীষ্য হওয়ার কারণেও তা সম্ভব। আউলেচাঁদের জন্ম নিয়েও সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না, মোটামুটি ভাবে যা জানা যায় তা হল---- শ্রীচৈতন্যদেব তাঁর অন্তলীলার শেষভাগে টোটা গোপীনাথ মন্দিরে অন্তরাল হন, সেখান থেকে সন্ন্যাসীর বেশে ঘোলা দুবলী নামক জায়গায় থাকার পর উলা গ্রামে (বীরনগর) মহাদেব বারুুইয়ের পানের বরজে এক পরম সুন্দর বালক মূর্তিতে দেখা দেন। মহাদেবের কোন সন্তান না থাকায়়় তিনি পরম যত্নে ছেলেকে বড় করে তোলেন। বার বছর সংসারে থাকার পর তিনি গৃহত্যাগ করেন দেশ ভ্রমণ করে ফকির বেশ ধারণ করেন। তার প্রধান ২২ জন শিষ্য ছিল, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য--- বেচু ঘোষ, হটু ঘোষ, রামশরণ পাল, কানাই ঘোষ, হরি ঘোষ, নিত্যানন্দ দাস প্রমুখ। এনাদের মধ্যে রমশরণ পাল বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য।
“আউলে চাঁদ দোয়া গরু
সঙ্গে বাইশ ফকির বাছুর তার।”
কর্তা ভোজিদের সাধন পদ্ধতি খুবই সাধারন এরা নিজেদের আরাধ্য সর্ব শক্তিমান ঈশ্বরকে “কর্তা” বলে সম্বোধন করে, ও তার ভাজনায় একমাত্র কর্তব্য, তাই এদের “কর্তাভজা” বলা হয়। এদের গুরুদের “মহাশয়” ও শিষ্যদের “বরাতি” বলা হয়। এই মহাশয়গণ নারী পুরুষ, হিন্দু মুসলিম যে কেউ হতে পারেন। এরা আউলেচাঁদকে চৈতন্যের রূপ ও চৈতান্যচারিতামৃতকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মানলেও, ইসলামী সুফিবাদের প্রভাবও যথেষ্ট আছে --- একেশ্বরবাদে বিশ্বাস ও ঈশ্বরকে কর্তা বলে সম্বোধন তার প্রমাণ। হিন্দু শিষ্যের পাশাপাশি মুসলমান শিষ্যের সংখ্যাও এই সম্প্রদায়ে কম নেই। “সত্য” ও “সংযম”এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে ----
“মেয়ে হিজড়ে পুরুষ খোজা
তবে হয় কর্তাভজা।”
আউলে চাঁদের সম্বন্ধে অন্য একটি মতও প্রচলিত। বর্ধমানের কালনার রাজা প্রত্যপদিত্যের মৃত্যুর বারো বছর পর এক ব্যক্তি রাজ্সভায় উপস্থিত হয়ে নিজেকে প্রতাপাদিত্য দাবী করতে থাকেন। তার মৃত্যু সম্বন্ধে তিনি বলেন, কোনো এক পাপার প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তাকে বারো বছর অজ্ঞাতবাস থাকতে হতো। তাই তিনি মৃতপ্রায় অবস্থায় থাকার কৌশল রপ্ত করেন। মৃত্যুর পর তার দেহ গঙ্গায় ভাসানো হলে তিনি সেখান থেকে বেঁচে ফিরে যান। এই প্রতাপাদিত্যের নামে মামলা করা হয়, ও মেজিস্ট্রেট তাকে জাল বলে ঘোষণা করে বর্ধমান ছাড়তে বলেন। সেখান থেকেই তিনি জাল প্রতাপাদিত্য নাম পান। বর্ধমান ছেড়ে নদীর এপারে এসে ফকির বেশ ধরে সাত্যনাথ নাম নেন। পরে ইনিই আউলে চাঁদ হন। ঘোষপাড়া নিবাসী রমশরণ পাল ও তার দিত্বিয়া স্ত্রী সরস্বতী তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরু ঘোষপাড়ায় এসে এক ডালিম গাছের নীচে বেশকিছুদিন ছিলেন। তিনি রমশরণের স্ত্রীকে আশির্বাদ স্বরূপ সতী নাম দেন। ঘোষ পাড়ায় সেই ডালিমগাছ ও তার সংলগ্ন পবিত্র পুকুর ঘিরে সতী মায়ের মন্দির গড়ে ওঠে। দোল পূর্ণিমার বিশাল মেলা হয়।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ঘোষ পাড়া ও রমশরণ পালের পরিবার অতিব গুরুত্বপূর্ণ। তারা নিজের বাড়িকে “বসত বাড়ি” ও ঘোষপাড়াকে “বাড়ি” মনে করে। এই সম্প্রদায়ের বিস্তারের পেছনে সতীমা ও তার পুত্র রমদুলালের যথেষ্ট অবদান আছে। তাই এদের “শ্রীযু্ত” বলা হয়।।