breaking

Friday, 18 June 2021

আমের সাতকাহন

“যে ব্যক্তি একটা পিপল, একটা নিম, একটা বট, একটা ডালিম, পাঁচটা আম ও দশটা ফুল গাছ রোপন করে, সে কখনো নরকে গমন করবে না।”
                                    ----বরাহ পুরাণ (১১৭.৩৯)
“ফলের রাজা আম” শুধুমাত্র ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রিয় ফলই নয়, ভারতীয় সংস্কৃতিতে এর একটা পবিত্রতাও আছে। আম্রপল্লব ছাড়া পূজা যেমন অসম্ভব তেমনি দক্ষিণের পোঙ্গাল বা বাঙালির জামাইষষ্ঠীর কথা আম ছাড়া ভাবাই যায় না। আমের উদ্ভব প্রথম এই ভারতবর্ষেই খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৪০০০ বছর আগে। বাল্মিকীর রামায়ণে আমের উল্লেখ বহুবার পাওয়া যায়, এছাড়াও বৈদিক সাহিত্যে আজকে আম্র, ছুট, রসাল প্রভৃতি নামে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমের উদ্ভব উত্তর ভারতে, এখান থেকে দক্ষিণ ভারতে গেলে তামিল ভাষায় এর নাম হয় “আম-কায়”(Aam-Kay), পরবর্তীকালে উচ্চারণে পরিবর্তন হয়ে নাম হয় “মামকায়”, মালায়ালাম ভাষায় তা হল “মাঙ্গা”(Manga)। ১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ নাবিকরা কালিকট বন্দরে নামলে তাদের হাত ধরেই বাইরে আমের বাণিজ্য শুরু হয় ও “মাঙ্গা”, “ম্যাংগো” নাম পায়। বিখ্যাত আম আলফানসো, পর্তুগিজরা de Albuquerque  এর নামে রাখে।
বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তারের সাথে সাথে আমেরও বিস্তার লাভ ঘটে। গৌতম বুদ্ধ আম গাছের তলায় ধ্যান করতেন বলে বৌদ্ধ ধর্মে আম গাছের একটি গুরুত্ব আছে। বৌদ্ধধর্মে আমগাছ রোপন করা কে পবিত্র কর্ম বলে গন্য করা হতো। জৈন দেবী অম্বিকাকে আম গাছের তলায় ধ্যানরত অবস্থায় দেখা যায়।
(আম গাছের তলায় ধ্যানরত বুদ্ধ, যাকে উপঢৌকন দিচ্ছেন আম্রপালিি)

শুধু ধর্মীয় নয় আমের ঐতিহাসিক গুরুত্বও যথেষ্ট। বৈশালী রানী আম্রপালির নাম অনুযায়ী বিখ্যাত আম আম্রপালির নামকরণ হয়। নন্দ সাম্রাজ্যের সময় আম গাছকে প্রেমের দেবতা মনমথ এর সাথে তুলনা করা হতো, আর আমের মুকুলকে প্রেম বান।
আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণের পর প্রত্যাবর্তনের কালে তার সাথে যে সমস্ত জিনিস নিয়ে গিয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম বিভিন্ন প্রজাতির আম। ইউ এন সাং ভারত ভ্রমণের পর প্রথম আম চীনে নিয়ে যান। 
মুঘল সম্রাট বাবর রানা সঙ্গকে আক্রমণ করতে অস্বীকৃত ছিলেন, দৌলত খাঁ লোদী বাবর কে সম্পত্তি ও অর্থের লোভ এর পাশাপাশি আমের সাথেও পরিচিতি ঘটায়। বাবর আমের স্বাদে এতটা মত্ত হয়ে যায় যে, কাবুল অবধি আমের কুরিয়ারের ব্যবস্থা শুরু করে।
আমির খসরু তাঁর লেখনীতে আমকে “Naghza Tarin Mewa”(the fairest fruit of Hindustan) বলে উল্লেখ করেছেন। সম্রাট আকবর দ্বারভাঙ্গা জেলায় “লাখি বাগ” নামে একটা বাগান তৈরি করেন, যেখানে এক লাখের বেশি আম গাছ রোপন করা হয় ও তোতাপুরী, রাতাউল, কেসার প্রভৃতি নতুন প্রজাতির আম গাছ গ্রাফটিং করা হয়। 
শাহাজাহানের আম প্রেম ছিল যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। কথিত আছে, শাহজাহান তাঁর পুত্র দারাশুকোকে সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন তার অন্যতম কারণ দারাশুকো একজন উন্নত মানের উদ্ভিদ বিশারদ ছিলেন। তিনি তার গ্রন্থ --Nuskha Dar Fanni Falahat এ বিভিন্ন প্রকার আমের গ্রাফটিং এর কথা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
ঔরঙ্গজেব সিংহাসন আরোহন কালে পার্শিয়ান নবাব আব্বাসের সমর্থন লাভের জন্য উপঢৌকন হিসেবে পাঠিয়েছিল আম।
১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে শের শাহ শুরি হুমায়ুনের বিরুদ্ধে চৌসার যুদ্ধে জয়লাভের পর, সেখানকার আম তৃপ্তিভরে খেলেন। স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় সেই আমের নাম রাখলেন “চৌসা”।
আমের কাহিনী ব্যক্ত করতে গেলে  আস্ত একখানি উপন্যাস তৈরি হয়ে যাবে, তাই এখানেই শেষ করা হলো আমের সাতকাহন।