ট্রাক ড্রাইভার
এই রিমি .. রিমি.. কোথায় তুই সন্ধে হয়ে গেলো তাড়াতাড়ি বাড়ি আই পরতে বস দু দিন বাদে তোর মাধ্যমিক পরীক্ষা আর তুই এখনও খেলে বেরাচ্ছিশ কাল তোর বাবা আসুক তারপর তোর খেলা বের করছি দারা। রিমি ঝট পট এসে হাত পা ধুয়ে পরতে বসে পড়লো ।
রিমিদের বাড়িটা পাহাড়ি এলাকায় এক প্রত্যন্ত গ্রামে এখনও ঠিক মতো আলো পৌঁছায়নি ওখানে।। তাই রিমি ঝটপট হ্যারিকেন টা জ্বালিয়ে বসে পড়লো।। আর রিমির মা উনুন জ্বালিয়ে রান্না বসিয়ে দিলো দোকান থেকে কিছু আলু নিয়ে এসেছে ও পাশের জঙ্গল থেকে কিছু শাকপাতা তুলে এনেছে হয়তো আজ এই রাত টা তারা এটা দিয়েই চালিয়ে দেবে।। হারিকেনের মৃদু আলোতে রিমির মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে যেনো নিষ্পাপ শিশুকেও হার মানিয়ে দেবে।। তখন সবে মাত্র চাঁদটা পাহাড় বেয়ে উপরে উঠছে পাখিগুলো কিচিরমিচির ডাক বন্ধ করে তাদের বাসায় ফিরে গেছে। দূরে এক পাহাড় থেকে শ শ করে বিষ্টির আওয়াজ আসছে তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে কোন এক খরস্রোতা নদী অজানা এক গন্তব্য স্থলের দিকে রওনা দিয়েছে।।
হঠাৎ এক বড়ো দাড়িওয়ালা লোক এসে রিমির মায়ের সামনে দাড়ালো লোকটাকে রিমির মা চেনে তার বাবার সাথে সে অনেকবার তাকে দেখেছে রিমির বাবার সাথে হয়তো কাজ টাজ করে কিন্তু হঠাৎ লোকটা মুখটা সংকুচিত করে যে কথাটা বলতে শুরু করলো তার জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত ছিল না।। রিমির বাবা গণপিটুনি তে মারা গেছে।। ওই নিথর দেহ টা মর্গে রাখা আছে।। শুনে রিমির মা মাথায় কিছুক্ষণের জন্যে হাত দিয়ে বসে পড়লো।। রিমি ছুটতে ছুটতে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাদতে লাগলো। ওর মা যেনো কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললো।। বাঁধ ভাঙ্গা জলের মতো ওর মায়ের চোখ ভিজে গেলো কাদতে কাদতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো " হে ভগবান আমরা কি দোষ করেছি আমরা তো শুধু খেয়ে পরে বাঁচতে চেয়েছিলাম সেটাও তুমি কেড়ে নিলে" ।। প্রতিবেশী কিছু মানুষ এসেছিলো সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কিন্তু তারাও কোনও বলার ভাষা না পেয়ে চলে গেলো।। ওরা মাটিতে শুয়েই কাদতে লাগলো।
রিমির বাবার নাম বিমল সে ট্রাক চালায় ।প্রতিদিনের মতো সেদিনও সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠেই তার বন্ধু আব্দুল কে ডাকতে গেলো ,ট্রাকের মালিক নাকি তাকে ডেকেছে । কোনরকম স্নান করে দুটো ফেনা ভাত খেয়ে বিমল বেরিয়ে পড়লো মালিক এর বাড়ির উদ্দেশ্যে। মালিকের বাড়ি পৌঁছে দেখলো মলিক তখন চেয়ার এ বসে সিগারেট ধরিয়েছে সেই জ্বলন্ত সিগারেটটা ফেলে পা দিয়ে টিপে মুখ দিয়ে ধোয়া ছেড়ে তাদেরকে বসতে বললো। মালিক তাদের কে বললো এক লরি পাথর দিয়ে আসতে হবে ভিন রাজ্যে খুব জরুরী প্রয়োজন দু দিনের মধ্যে পৌঁছাতে হবে না হলে অনেক টাকা লোকসান হয়ে যাবে।। ফলে সেদিন তারা প্রস্তুত হয়ে গেলো সেদিন রাতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মালিক তাদের কে হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে দিলো খাওয়া খরচ বাবদ।। রাত এগারোটা নাগাদ যাত্রা শুরু করলো। ঘুম বন্ধ করে চালাতে লাগলো।। সোজা রাস্তা বেয়ে আপন বেগে চলতে লাগলো গাড়ি। চারিদিকে চাদের আলোয় মাখামাখি হয়ে গেছে। পাশ দিয়ে গাছ গুলো ছুটে চলেছে যেনো তাদেরকেও গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে হবে। রাতের জোনাকি গুলো যেনো খেলা শুরু করে দিয়েছে।। লরির ভিতরে মৃদু গান চলছে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা গাড়ি তাদের কে ধাওয়া করা শুরু করেছে, তাদের গাড়িটা থামিয়ে কিছু মানুষ তাদের মারধর করে টাকা কেড়ে নিয়েছে যেটা মালিক তাদেরকে খওয়ার জন্য দিয়েছিল।। তারা নিজেদেরকে খুব অসহায় মনে করতে লাগলো আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগলো। যাইহোক এই ভাবে তাও চলতে শুরু করলো কারণ মালিকের লোকসান হলে যে তাদের কাজ চলে যাবে ছেলে মেয়ে নিয়ে পথে বসতে হবে।। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা পুলিশের গাড়ি থামার জন্য সিগনাল দিছিলো। তারা থামে তাদেরকাছে কাগজপত্র চাওয়া হয় এবং সেটা দেখানোর পরও তাদের কাছে ঘুষ চাওয়া হয় কিন্তু তারা সেটা দিতে না পারায় তাদের লাথি ঘুষি দিয়ে মুখ থেকে রক্ত বের করে দেই এছাড়াও অজস্র গালিগালাজ করা হয়।। সব সহ্য করেও ছেলে মেয়ের কথা চিন্তা করে আবার চলতে শুরু করে।। চলতে চলতে ভোর হয়ে যায়। পাখিগুলো কিচিরমিচির ডাক শুরু করে দিলো তারাও খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়লো। সূয্যি মামাও পূবের আকাশে উকি মারা শুরু করেছে ।। এই ভাবে চলতে লাগলো । কিন্তু সেই অসময় ঘনিয়ে আসলো সকাল ১০ টা বাজে তখন হঠাৎ একটি বয়স্ক লোক সাইকেল নিয়ে গাড়ির সামনে চলে আসে কিন্তু শত চেষ্টা করেও বিমল তাকে আটকাতে পারলো না সে পড়লো গাড়ির সামনে এবং তাকে পিষে দেই বৃদ্ধ লোকটি তৎক্ষণাৎ মারা যায়।। সেইমাত্র আব্দুল লরি থেকে পালিয়ে যায় কিন্তু বিমলকে কিছু স্থানীয় লোক ধরে ফেলে এবং মাটিতে ফেলে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো। বিমলের নাক মুখ থেকে রক্ত বেরোতে লাগলো কাটা মাছের মতো ছটফট করতে লাগলো কেও তাকে বাঁচাতে আসলো না মুখে একফোঁটা জল পর্যন্ত কেউ দিতে আসলো না কিছুক্ষন পর পুলিশ এসে তার দেহ টা নিয়ে গেলো হাসপাতালে কিন্তু ততক্ষণে সময় শেষ ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে তাকে চলে যেতে হলো না ফেরার দেশে।।
সমস্ত দোষ কি শুধু মাত্র খেটে খাওয়া মানুষদের??? বিমলের তো কোনো দোষ ছিলো না তার মালিকের লাভের জন্যে সে সারারাত জেগে ক্ষুধার্ত পেটে খেটে যাচ্ছে শুধু মাত্র তার পরিবারকে বাঁচানোর জন্যে।। এইরকম লক্ষ লক্ষ বিমল আমাদের দেশে আছে। যাদের কথা আমার দেশ ভাবে না।। ওদের সুরক্ষার কোনও ব্যবস্থা করা হয় না।। আর রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তাহলে তাদের আর কষ্টের সীমা থাকবে না।।।
চাঁদ এখন মাঝ আকাশে আমরা নীরবে ঘুমিয়ে যাচ্ছি আর লক্ষ লক্ষ বিমল রাত জেগে ছুটে চলেছে পরিবারকে বাঁচানোর জন্যে।
লেখা- চিন্ময় হালদার