breaking

Tuesday 25 May 2021

বাংলার লোকদেবী চন্ডী

ভারতীয় উপমহাদেশে নারী উপাসনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, হরপ্পা সভ্যতায় প্রাপ্ত নারী মূর্তি যার প্রমাণ বহন করে। যেখানে নারীকে শক্তিরুপে পূজা করা হতো। এই শক্তিরূপিণী নারী দেবীই পরবর্তীকালে কখনো দুর্গা কখনো কালি বা কখনো চন্ডী রূপে পূজিত হয়ে এসেছে।

“চন্ডী” বা “চন্ডিকা” দেবীর উল্লেখ মেলে মার্কন্ডেয় পুরাণের ৮১তম থেকে ৯৩তম অধ্যায়ে, এই তেরো টি অধ্যায়কে “দেবীমাহাত্ম্য” বা “শ্রীশ্রীচণ্ডী” অধ্যায়ও বলা হয়। চন্ডী বা চন্ডিকা নামের অর্থ প্রচন্ড শক্তিশালী। শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী, চন্ডী ব্রহ্মশক্তি বা পরমব্রহ্ম মহিষী। জ্ঞান, ইচ্ছা, ক্রিয়া -এই ত্রিশক্তির সমষ্টিভূত রূপ দেবী চণ্ডী।
অন্যমতে, মহাযোগ নিদ্রায় অভিভূত বিষ্ণুর উপদ্রবকারী মহাদৈত্য মধু কৈটভকে নিধনের জন্য বিষ্ণুর মহাযোগ নিদ্রা থেকে মুক্ত হলেন এবং সেই যোগনিদ্রা থেকে উৎপত্তি হলো মহাকালী রূপ। নিধন হল মধুকৈটভ। পরে শুম্ভ নিশুম্ভর সেনাপতি চন্ড মুন্ড উৎপাত আরম্ভ করলে মহাক্রোধান্বিতা দেবীদেহ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ রূপ ধারণ করে, তার ললাট থেকে নির্গত হয় করালবদনা কালী, প্রবল যুদ্ধে চন্ড এবং মুণ্ড কে বধ করে সেই মস্তক উপহার দিলেন দেবীকে। যে দেবীর ললাট থেকে করালি কালী আবির্ভূতা হয়েছিলেন সেই দেবী চণ্ডিকা নামে পরিচিত।
রাঢ় বঙ্গে লোকপ্রিয় দেবী চণ্ডী মূলত বৌদ্ধ দেবী চুন্ডা-রই নামান্তর।
 
  লৌকিক দেবীরূপে পুরো বাংলা জুড়ে দেবী চণ্ডী বহুল পূজিত হন। মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যধারায় মঙ্গলকাব্য অন্যতম জনপ্রিয় বিশেষত মঙ্গলচণ্ডী কাব্য। এই মঙ্গল চন্ডী কাব্যের অন্যতম লেখকেরা হলেন -- মানিক দত্ত, দ্বিজ মাধব, কবিকিঙ্কর মুকুন্দ চক্রবর্তী।
এই মঙ্গল কাব্য গুলির বিভিন্ন গল্প গুলির মধ্যে কালকেতু ও ফুল্লরার কাহিনী, ধনপতি ও শ্রীমন্ত সওদাগরের কাহিনী বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
ধনপতির প্রথম স্ত্রী লহনা নিঃসন্তান থাকায় ধনপতি খুল্লনাকে বিবাহ করেন। খুল্লনা স্বর্গভ্রষ্টা অপ্সরা রত্নমালা, যিনি পৃথিবীতে চণ্ডীর গুনোগান করতেই এসেছিল। ধনপতি ছিলেন শিবের উপাসক তাই তিনি চন্ডী সহ অন্যকোন দেবীকেই মানতেন না। একদা ধনপতি বাণিজ্য করতে বেরোবার সময় খুল্লনা তাকে চন্ডী পূজা করতে বলেন, ধনপতি অস্বীকার করেন।   বাণিজ্যে যাবার কার সময়, চণ্ডীর রোষে তার সমস্ত নৌকা ডুবে যায় কোনরকম একটি নৌকা নিয়ে তিনি প্রাণে বাঁচেন, সেখানে তিনি চণ্ডীর মায়ায় চণ্ডীর “কমলে কামিনী” রূপ দেখেন, সিংহল রাজ্যে পৌঁছে রাজাকে সব ঘটনা বললেন কিন্তু সেই দেবীরূপে রাজাকে দেখাতে পারেন না তাই তাকে বন্দী করা হয়। ধনপতির পুত্র শ্রীমন্ত সওদাগর (চণ্ডীর বরপুত্র স্বর্গভ্রষ্ট মালাধর ) পিতাকে উদ্ধার করতে বের হন। এই উদ্ধার পথেই তার নৌকা গঙ্গাবক্ষে আটকা পরে ও শ্রীমন্ত সওদাগর বিপদ থেকে মুক্তির জন্যদেবী চণ্ডীর পূজা করেন।
বাংলায় শক্তিরূপে চণ্ডীর আরাধনার এক অন্যতম কারণ হল বৈষ্ণবদের প্রভাব বিস্তার।বাংলায় বৈষ্ণববাদ ছড়িয়ে পড়তে থাকলে ব্রাহ্মণরা নিজেদের অস্তিত্ব সংকটে ভুগতে থাকে, তাই বৈষ্ণববাদের বিরোধী রূপে তারা শাক্ত বা শক্তির আরাধনা শুরু করে, যেখানে বলি প্রথা ছিল অন্যতম।
বাংলায় বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন চন্ডী পূজা হয়ে থাকে, যেমন:- কাঁকড়া চন্ডী, ডাকাই চন্ডী, ব্রাহ্মণ চন্ডী, গ্রাম দেবী চণ্ডী, ওলাইচন্ডী, বসন্ত চন্ডী, বুলবুলচন্ডী, মুন্ডাই চন্ডী প্রভৃতি।